মহান স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছরে এই সোনার বাংলাদেশে অনেক উন্নয়নই হয়েছে।
রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি গ্রাম এখন শহরে পরিণত হচ্ছে।
কিন্তু দীর্ঘ এই ৫০ বছরে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজরিত টাঙ্গাইল বন বিভাগের মধুপুর বনাঞ্চলের ‘দোখলা’ এলাকায়। আর বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত সেই চেয়ার-টেবিল যত্নে থাকলেও অযত্ন আর অবহেলায় বন বিভাগের দোখলা রেস্ট হাউজটি ভিআইপিদের অবকাশ যাপনের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লাগানো আম গাছটির ডালপালা কেটে ফেলার পর এখন মৃত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। টাঙ্গাইল শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তর দিকে মধুপুর গড়াঞ্চলের অরণখোলা মৌজায় দুটি খালের মিলনস্থলই ‘দোখলা’ হিসেবে পরিচিত।
মধুপুর বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের চারণভূমি দোখলা এলাকা। বন পরিদর্শনকারী ভিআইপিদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ ও বিশ্রামের জন্য দোখলায় বন বিভাগ একটি রেঞ্জ ও বিট অফিসারের দুটি কার্যালয় এবং ১৯৬২ সালে দোখলা রেস্ট হাউজ স্থাপন করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগড়িষ্ঠতা পাওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তাদের ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে নিয়ে বিশ্রামের জন্য বনের মধ্যে নিরিবিলি ও নিরাপদ দোখলা রেস্ট হাউজে যান। ১৯৭১ সালের ১৮ থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত দোখলা রেস্ট হাউজে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে তাদের জীবনমান ও পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে বলেন।
তিনি স্থানীয় চুনিয়া গ্রামের আদিবাসী গারো রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ এর বাড়িতে গিয়ে মধুপুর বনাঞ্চল সংরক্ষণ ও উন্নয়নে মতবিনিময় করেন। তিনি চুনিয়া গ্রামের গারো রাজার সঙ্গী জগদীস নকরেক ওরফে জনিক নকরেক ও দোখলার মোশারফ হোসেনসহ অনেকের সাথেই তৎকালীন আন্দোলন সংগ্রামের বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু মধুপুর বন ও বনে বসবাসরত আদিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আন্দোলন সংগ্রামে তাকে সব সময় পাওয়া যাবে বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু দোখলায় থাকাকালে প্রতিদিন স্থানীয়দের সঙ্গে দেখা করলেও দোখলা ডাকবাংলোতে রাতযাপন করেছেন। বাংলোতে তিনি যে চেয়ারটিতে বসতেন ও টেবিল ব্যবহার করেছেন তা যত্ন করেই রাখা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা এবং ছোটশিশু শেখ রাসেলের স্মৃতিধন্য দোখলা রসুলপুর সাত কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তাটি মহান স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সংস্কার বা পুননির্মাণ করা হয়নি। দোখলা রেস্ট হাউজটির সামান্য সংস্কার করা হলেও তা আধুনিক নয়। বন বিভাগের রেঞ্জ ও বিট কার্যালয় দুটিরও কোনও উন্নয়ন হয়নি। জাতির পিতার নিজ হাতে লাগানো আম গাছটির ডালপালা প্রায় দুই বছর আগে কেটে ফেলায় পরিচর্যার অভাবে অযত্ন অবহেলায় এখন শুকিয়ে মরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বন বিভাগের দোখলা রেস্ট হাউজের পরিদর্শন বইয়ে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের কোনো প্রমাণই রাখা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল ১৯৭৪ সালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনে এসে দোখলা রেস্ট হাউজে অবস্থান করেন।
স্থানীয়দের ধারণা, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশে কলঙ্কিত অধ্যায় শুরু হয়। দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামীলীগ ক্ষমতার বাইরে থাকায় জাতির পিতার সে সময়ের সব স্মৃতি সুকৌশলে মুছে ফেলা হয়েছে।
শতবর্ষী জগদীস নকরেক ওরফে জনিক নকরেক জানান, বঙ্গবন্ধু ক্লান্তি কাটাতে দোখলায় বিশ্রাম নিতে এসেছিলেন। ঢাকার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলেন। হয়তো খুব বেশি লোককে জানাননি কোথায় আছেন। তিনি জানান, গারো রাজা চুনিয়া গ্রামের পরেশ চন্দ্র মৃকে বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে চিনতেন। বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতা ছেড়ে আসেন, তার বছর দুয়েক আগে পরেশ মৃ কলকাতায় গিয়েছিলেন। পরেশ চন্দ্র মৃ দেশভাগের কিছুদিন পর কলকাতা থেকে মধুপুরের চুনিয়ায় ফিরে আসেন। ফিরে এসেই গারোদের জুমচাষ নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সত্তরের নির্বাচন শেষে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে যে টানাপড়েন শুরু হয়েছিলো তা নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত ছিলেন। ৩ জানুয়ারি জনগণের সামনে নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের তিনি শপথ করিয়েছিলেন। ১৩ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।
ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের মধুপুর অঞ্চলের সভাপতি উইলিয়াম দাজেল জানান, মহান স্বাধীনতার পর একটা দীর্ঘসময় স্বাধীনতাবিরোধিরা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় বন বিভাগের তৎকালীন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জাতির পিতার স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে।
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার ভ্রমণের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য টাঙ্গাইল বন বিভাগ দোখলা ভিভিআইপি ডাকবাংলো চত্বরে শ্বেতপাথরে খোদাই করা একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেছে। মধুপুর বনাঞ্চল পরিদর্শনে আসা পর্যটক ও বনভোজনকারীদের জন্য তা এখন বাড়তি আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. মো. জহিরুল হক বাংলানিউজকে জানান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য দোখলা রেস্ট হাউজটি আংশিক সংস্কার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে রেস্ট হাউজের কাছে একটি অত্যাধুনিক ডাকবাংলোর নির্মাণ চলমান রয়েছে।