বাংলাদেশ

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পালনেও করা হয়েছে হেলাফেলা

দশ মাস আগে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছিলেন সব জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে অক্সিজেন ট্যাংক এবং আইসিইউ শয্যা স্থাপনের। কিন্তু দীর্ঘ এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা পালনেও করা হয়েছে হেলাফেলা। দেশে করোনা রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র সংকট আইসিইউ শয্যার। রীতিমতো হাহাকার। নিশ্চিত হয়নি নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহও। এ ছাড়া করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম প্রয়োজনের তুলনায় এ মুহূর্তে অপ্রতুল। করোনা সংক্রমণ উঠানামার মধ্যে রয়েছে। মৃত্যুও শতকের কাছাকাছি ঘুরছে প্রতিদিন।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে চলতি মাসেই দুই হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। আর এ পর্যন্ত এগারো হাজারের বেশি মৃত্যুর তালিকায় রয়েছেন। শনাক্ত সাড়ে ৭ লাখ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা রোগীদের অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে শ্বাসকষ্ট অন্যতম। যেসব রোগীর শ্বাসকষ্ট সহনীয় মাত্রায় থাকে, তাদের শ্বাস গ্রহণের জন্য অক্সিজেন নেয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যাদের শ্বাসকষ্টের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়, তাদের শ্বাসযন্ত্র সচল রাখতে বাইরে থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। অনেক জীবন বাঁচাতে দরকার হয় নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ। করোনা সংকট শুরু হওয়ার আগে হাসপাতালগুলোতে যে পরিমাণ অক্সিজেন লাগতো, বর্তমানে তার চাহিদা বহুগুণ বেড়ে গেছে। যদিও দাবি করা হচ্ছে হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের কোনো অভাব নেই। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হাসপাতালগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর পরিবর্তে তারা অক্সিজেন সিলিন্ডারের উপর নির্ভর করে। ফলে, শ্বাসকষ্টে ভুগছেন এমন করোনা রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের অর্থ একটি হাসপাতালে নির্দিষ্ট জায়গায় অক্সিজেনের মজুত থাকবে, যেখান থেকে পাইপের মাধ্যমে রোগীদের শয্যায় অক্সিজেন সরবরাহ করা হবে।

এ বিষয়ে জাতীয় পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, গত বছরের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন দেশের সবগুলো জেলা হাসপাতালে আইসিইউ’র ব্যবস্থা করা হবে। এ সময় মোট ২৮টি জেলায় হলেও বাকি ৩৬টি জেলাতে এখনো হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কিন্তু মানা হলো না। এটা কিন্তু ম্যানেজমেন্টের বিরাট একটি পরিবর্তন। এর আগে আমরা দেখেছি অন্তত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মানা হতো। এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা গেছে। ৭৯ সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের মধ্যে ২৯টি প্রজেক্ট সম্পন্ন হলেও ৫০টি হয়নি। এই হলো আমাদের কাজের নমুনা। এরকম পরিস্থিতি নিয়ে আমরা দ্বিতীয় ঢেউ ফেস করতে গিয়েছি। অর্থাৎ, সেকেন্ড ওয়েভ আমাদের এই প্রস্তুতি নিয়ে আমরা পরিস্থিতি ম্যানেজ করতে চেষ্টা করলাম। এতে করে যে সব জেলাতে আইসিইউ’র ব্যবস্থা নেই সেই রোগীগুলোকে ঢাকায় পাঠানো হলো। আমাদের রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। ফলে আমাদের মৃত্যু হার বেড়ে গেল।
দেশে কতোগুলো জেলার সরকারি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ আছে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া মানবজমিনকে বলেন, দেশের প্রায় সব জেলা হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন বসানো হয়েছে। ১২১টি প্রতিষ্ঠানে বা হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। ২৮টি হাসপাতালের কাজ বাকি আছে। এরমধ্যে ১৮টির স্থাপন চলমান রয়েছে। বাকিগুলো প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ১০টির কাজ এখনো শুরু হয়নি।

করোনা রোগের চিকিৎসায় রোগীদের লিক্যুইড অক্সিজেন ট্যাংক থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা নেই অনেক সরকারি হাসপাতালে। ফলে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীদের সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা হলেও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বলে স্বাস্থ্য কর্মীরা জানিয়েছেন। ফলে চিকিৎসা নিতে গিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রোগীদের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, আমাদের দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের সুযোগ নেই। যেসব হাসপাতালে লিক্যুইড অক্সিজেন ট্যাংক এখনো স্থাপন করা হয়নি, সেসব হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে লিক্যুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে নতুন যেসব হাসপাতাল গড়ে তোলা হবে, সেখানে শুরু থেকেই যাতে এসব জরুরি বিষয় সংযুক্ত রাখা হয়, সে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

এদিকে গতকাল এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি বলেছেন, এই মুহূর্তে দেশে কোনো অক্সিজেন সংকট নেই। আমাদের দেশের অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা অন্য কোনো দেশের উপর নির্ভর করে না। সারা বছর ভারত বা অন্য কোনো দেশ থেকে অক্সিজেন আমদানি করার প্রয়োজন পড়েনি। করোনার পিক অবস্থায় ভারত থেকে কিছু অক্সিজেন আমদানি করা হয়েছিল। এখন ভারতের কঠিন সময় যাচ্ছে। এই সংকটে ভারত অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করলেও এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তাছাড়া লিক্যুইড অক্সিজেনের তুলনায় গ্যাস অক্সিজেনের উৎপাদনে আমাদের সক্ষমতা অনেক বেশি। গ্যাস অক্সিজেনে এখন দিনে আড়াই শ’ টন অক্সিজেন উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। লিক্যুইড অক্সিজেন দেড় থেকে দুই শ’ টন উৎপাদন হয়। দেশের বেসরকারি মেডিকেল খাতেও ৪০ থেকে ৫০ টন অক্সিজেন উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। প্রয়োজনে সেগুলোকেও নেয়া যাবে। এর তুলনায় দেশে বর্তমানে দৈনিক চাহিদা এক থেকে দেড় শ’ টন মাত্র। চাহিদা দ্বিগুণ হলেও অক্সিজেন সংকট এই মুহূর্তে হবে না। তবে, রোগী সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেলে তখন ভিন্ন চিত্র দেখা দিতে পারে। এ জন্য রোগী যাতে না বাড়ে সেদিকে সকলের মনোযোগী হতে হবে।

সম্পর্কিত

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button