বিশ্ব

মহাকাশে যেতেই কি অ্যামাজনের পদ ছাড়লেন জেফ বেজোস?

২০০৪ সালের এক সুন্দর দিনে জেফ বেজোস অ্যামাজনের তৎকালীন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার কলিন ব্রায়ারকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন ওয়াশিংটনের ছিমছাম মফস্বল শহর টাকোমাতে। যেখানে তারা ২ দিন কাজ করেছিলেন অ্যামাজনের কাস্টোমার কেয়ার সার্ভিস এজেন্ট হিসেবে। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ব্রায়ার বলেন, ওই দুইদিন সত্যি সত্যিই জেফ নিজে গ্রাহকদের ফোন কল অ্যাটেন্ড করছিলেন শুধু তাদের অভিযোগগুলো শুনতে। কথা বলতে গিয়ে প্রায় প্রত্যেকবারই জেফের চোখ বড় হয়ে যাচ্ছিল। কাস্টমারদের অভিযোগ নিয়ে সেদিন খুবই হতাশ ছিলেন জেফ। কারণ জেফের মতে, ব্যবসায় লাভ করা খুবই কঠিন যদি না আপনার কাস্টমাররা খুশি থাকে।

ঠিক ২৭ বছর পর সোমবার জেফ বেজোস ছেড়ে দিয়েছেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ই-কমার্স কোম্পানি অ্যামাজনের  প্রধান নির্বাহীর পদ। তার স্থলাভিষিক্ত হলেন ১৯৯৭ সালে থেকে সাথে থাকা সহকর্মী অ্যান্ডি জেসি। শেয়ারহোল্ডারদের সর্বশেষ বৈঠকে বেজোস বলেছেন, আমি এই দিনটি বেছে নিয়েছি কারণ দিনটি আমার জন্য আবেগময়। ১৯৯৪ সালের এই দিনে আমাজন করপোরেশন হিসেবে নিবন্ধিত হয়, ঠিক ২৭ বছর আগে। ২৭ বছরের এই দীর্ঘ যাত্রায় অনেক আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি করেন এই বিশ্বখ্যাত টেক মাস্টারমাইন্ড।

এই ২৭ বছরে তিনি অ্যামাজনের জন্য খুবই অদ্ভুত কিছু নিয়ম তৈরি করেন। এসব নিয়ম নিয়ে অ্যামাজনের ম্যানেজারিয়াল বোর্ডের অনেক সদস্যেরই ঘোর আপত্তি থাকলেও বেশিরভাগ ম্যানেজারই বিশ্বাস করেন ‘কাস্টমার অবসেশন’ দূর করতে জেফের এই অদ্ভুত নিয়মগুলো খুবই কার্যকর।

সর্বোচ্চ নির্বাহী হিসেবে বেজোসের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি এসেছে নিউইয়র্ক ভিত্তিক সংগঠন প্রোপাবলিকা’র এক প্রতিবেদনে। সংগঠনটি দাবি করছে ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কোনো কর দেননি জেফ বেজোস। এছাড়া অনেক পুরোনো কর্মচারি জেফের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তার জুয়াড়িদের মতো মানসিকতা, কর্মচারিদের প্রতি নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি।

শৈশব থেকেই জেফ প্রকৌশল, যন্ত্রপাতি ও নতুন কিছু আবিস্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। মানবিক গুণ হিসেবে এগুলো খুব খারাপ না হলেও জেফের সমালোচকদের মতে, তার এই অবসেশনের ফল খুবই মারাত্মক হয়েছে অ্যামাজনের ওয়্যারহাউসে নিয়োজিত অসংখ্য কর্মচারির জন্য। কারণ, এই কর্মচারিরা জেফের জন্য মেশিনের মতো কাজ করতে পারেন না। সাথে সর্বক্ষণ মনিটরিং এ থাকার দমবন্ধ করা অনুভূতি তো আছেই।

যদিও বেজোসের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছেন। তাদের মতে বেজোস খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ ও দূরদর্শী একজন নেতা। ব্যবসা সম্বন্ধে জেফের দর্শন কিংবদন্তির চেয়ে কোনো অংশে কম না। তার দূরদৃষ্টির কারণেই অ্যামাজন ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।

২০০৪ সালে নাদিয়া সৌরাবৌরা অ্যামাজনে কাজ করতে শুরু করেন। তিনি বলেন, এক ক্রিসমাস ইভে আমি কোম্পানির খরচ বাঁচাতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। তখন আমার পদক্ষেপের ঘোর বিরোধিতা করে জেফ বলেছিলেন, তুমি ভুল করছো। কোম্পানির খরচ না বাঁচিয়ে আগে কাস্টমারদের খুশি করো, এতে কোম্পানিরই লাভ হবে।

বেজোসের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা বলছেন, জেফ ছোট ছোট দল নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন। এসব দলকে তিনি দিতেন স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ। জেফের মতে স্বাধীনভাবে কাজ করলে নতুন আইডিয়া জেনারেট করা সহজ হয়। এছাড়া পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের চেয়ে ক্যাশ মেমো হাতে নিয়ে মিটিং করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন জেফ।

অ্যামাজনের এক্সিকিউটিভ মিটিংগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে প্রায়ই বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠতো। নাদিয়া বলছেন, আমরা এক্সিটিকিউটিভ মিটিংয়ে প্রায়ই একজন অন্যজনের সাথে খুবই তীব্র ভাষায় তর্ক করতাম, কিন্তু এসব তর্ক হতো আইডিয়া নিয়ে, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে না। কারণ আমাদের কাজের পরিবেশ খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ।

এমনকি মিটিংয়ে যারা ডমিনেট করার চেষ্টা করতেন তাদের থেকে সম্ভাবনাময় আইডিয়াগুলো রক্ষা করতে অনেক আইডিয়াবাজের সাথেই সিঙ্গেল মিটিং করতেন জেফ। আর অ্যামাজনের জন্য এসব সিঙ্গেল মিটিং হয়েছিল খুবই লাভজনক।

এছাড়া যারা মিটিংয়ে দ্বিমত পোষণ করেন তাদেরকে খুবই পছন্দ করেন জেফ। জেফের মতে, যেকোনো সমস্যার পিছু ধাওয়া করতে পারাটা একটা গুণ। মিটিংয়ে দ্বিমত পোষনকারীদের কথা খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনতেন জেফ। তিনি মনে করেন দ্বিমত করতে সাহস লাগে, আর অ্যামাজনের ব্যবসাটা মূলত সাহসেরই। এজন্য প্রায়ই দুঃসাহসিক সব পদক্ষেপ নিতেন জেফ।

ব্যবসা নিয়ে সবসময়ই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে পছন্দ করেন জেফ। আর যেকোনো নতুন পরিকল্পনা হাতে নিলেই তিনি তা সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন সবার আগে, যা অন্যান্য কোম্পানিগুলো সর্বশেষে করে। জেফের মতে এতে লাভ হয় দুইটা। এক. আপনি কাজে নিয়মনিষ্ঠ হবেন। দুই, শেষ করার আগ পর্যন্ত আপনি কাজে ফাঁকি দিতে পারবেন না।

আগামী ২০ জুলাই জেফ তার স্বপ্নের প্রোজেক্ট স্পেস হোটেল বাস্তবায়নে মহাকাশ যাত্রা করবেন। ইতোমধ্যে প্রায় দেড়লাখ মানুষ একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন যে তারা চান না বেজোস আর পৃথিবীতে ফিরে আসুন। ভালোবাসুন বা ঘৃণা করুন জেফ ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গী আমূল পরিবর্তন করেছেন। আর তার এই অবদান তার ঘোরতর শত্রুরাও অস্বীকার করেন না।

সম্পর্কিত

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button